পটভূমি: ইতিহাসে মানব জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়। আর ইতিহাস রচনায় ভিত হিসেবে মানুষের ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের তথা ভূগোলের গুরুত্ব অপরিসীম। অধ্যাপক ডাডলি ষ্ট্যাম্পের মতানুসারে, ‘‘মানুষের আবাসস্থল হিসাবে পৃথিবী সম্বন্ধে পাঠ, মানুষ ও তার কর্মকান্ডের প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব আলোচনায় হল ভূগোল ’’। প্রকৃতির কোলে লালিত মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বিবর্তন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, ভৌগলিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল। তাই কোন দেশের বা অঞ্চলের আঞ্চলিক ইতিহাস-ঐতিহ্য রচনায় সর্বাগ্রে প্রয়োজন সেই অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থান, ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, নদ-নদী, সমুদ্র, প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষি উৎপাদন, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে সম্যক আলোচনা। গাইবান্ধা জেলার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও অত্র জেলার ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য সমূহের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হল।
অবস্থান: উত্তর বঙ্গের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী জনপদ গাইবান্ধা জেলা ব্রক্ষপুত্র নদের ডান তীরে ২৫০৩র্ থেকে ২৫০৩৯র্ উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮৯০১২র্ থেকে ৮৯০৪২র্ পূর্ব দ্রঘিমাংশের মধ্যে অবস্থিত।
সীমানা: গাইবান্ধা জেলার উত্তরে তিস্তা নদী এবং কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলা, উত্তর পশ্চিমে রংপুর জেলার পীরগাছা এবং পশ্চিম পার্শ্বে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর ও পীরগঞ্জ উপজেলা এবং দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট উপজেলা, পশ্চিম-দক্ষিণে জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলা এবং দক্ষিণে বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ ও সোনাতলা উপজেলা এবং পূর্ব পার্শ্বে বহমান ব্রক্ষপুত্র নদ।
আয়তন: গাইবান্ধা জেলার ৭টি উপজেলা যথাক্রমে (১) সদর (২) সুন্দরগঞ্জ (৩) সাদুল্ল্যাপুর (৪) পলাশবাড়ী (৫) গোবিন্দগঞ্জ (৬) ফুলছড়ি (৭) সাঘাটা উপজেলা। ৮২টি ইউনিয়ন, ১১০১টি মৌজা এবং ৪টি পৌরসভা (সদর ও গোবিন্দগঞ্জ) নিয়ে গঠিত। জেলার মোট আয়তন ২১৭৯.২৭ বর্গকিলোমিটার (১০৭.৭ বর্গকিলোমিটার নদীয় আয়তন সহকারে) এবং জনসংখ্যা ১৯৯১ সালের আদমশুমারী রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯,৪৯,২৭৪ জন।
ভূ-তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য: গাইবান্ধা জেলা বৃহত্তর বঙ্গ প্লাবন ভুমিতে অবস্থিত হলেও এর উপর দিয়ে প্রবাহিত নদী সমূহের গতিপথ পরিবর্তন এবং ভূ-কম্পনজনিত ভূ-উত্তোলনের ফলে এই জেলার ভূমি গঠনের বৈশিষ্ট্য অপরাপর জেলা গুলির চাইতে কিছুটা ভিন্নতর। গাইবান্ধা জেলার অধিকাংশ ভুমি নদী পলল দ্বারা গঠিত।
ভূ-প্রকৃতি: কোন দেশের কৃষি, শিক্ষা, ব্যবসা-বানিজ্য, পরিবহন, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং জনবসতির উপর সেই দেশের ভূ-প্রকৃতি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ভূ-প্রকৃতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
(ক) টারশিয়ারী যুগের পাহাড় সমূহ: টারশিয়ারী যুগে (আনুমানিক ৭৫ মিলিয়ন বছর আগে) হিমালয় পর্বত উত্থিত হওয়ার সমসাময়িক কালে এসব টিলা ও পাহাড়ের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হয়। তবে এই পাহাড় শ্রেণীর কোনরূপ বৈশিষ্ট্য গাইবান্ধা জেলায় লক্ষ্য করা যায় না।
(খ) প্লায়স্টোসিম যুগের সোপান সমূহ: প্রায় ১৩ লক্ষ বছর পূর্বে সূচনা হয়ে ২৫০০০(পuঁচশ হাজার) বছর পর্যন্ত কালকে প্লায়স্টোসিম যুগ বলা হয়। গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ পূর্বাংশের কয়েকটি ইউনিয়েন এই রকম বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় যা স্থানীয়ভাবে ‘খিয়ার’ এলাকা নামে পরিচিত।
(গ) নবীন ভূ-তাত্ত্বিক যুগের প্লাবন সমূহঃ টারসিয়ারী যুগের পাহাড় সমূহ এবং প্লায়স্টোসিম যুগের সোপান সমুহ ব্যাতিত সমস্ত বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা উৎপত্তি হয়েছে নবীন ভূ-তাত্ত্বিক যুগে (আনুমানিক ২৫০০০বছরের কম সময়ে) যা গাইবান্ধা জেলার অধিকাংশ ভূমি গঠনের ক্ষেত্রে বিদ্যামান। ক্ষুদ্র আয়তনের গাইবান্ধা জেলার টারসিয়ারী যুগের পাহাড় নাই। জেলার দক্ষিন পশ্চিমে প্লায়াস্টোসিম যুগে সৃষ্ট বরেন্দ্রভূমির কিয়দাংশ রয়েছে। জেলার অবশিষ্ট ৯০ ভাগ অংশ নবীন ভূ-তাত্ত্বিক যুগের প্লাবন সমভূমির অর্ন্তগত যা ব্রক্ষপুত্র, করতোয়া তিস্তা বিধৌত। কাজেই ভূ-প্রকৃতি ও মৃত্তিকার গঠন অনুযায়ী জেলাটিকে দু’ভাগে ভাগ করা যায় (ঋঅঙ-১৯৯১) যথাঃ (ক) প্লাবন সমভূমি (খ) বরেন্দ্র সমভূমি।
মাটির শ্রেণী: কোন স্থানের মাটির গুনাগুণের উপর সেখানকার অনেক কিছু নির্ভর করে। মাটির বুনটের ভিত্তিতে গাইবান্ধার মাটিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ ক) বেলে মাটি খ) দোঁয়াশ মাটি গ) এটেল মাটি।
ক) বেলে মাটি: ব্রক্ষপুত্র, তিস্তা, করতোয়া বিধৌত গাইবান্ধা জেলার নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলে বেলে মাটি দেখা যায়। বেলে মাটিতে চিনাবাদাম, চিনা, কাউন, সরিষা, আখ, তরমুজ ইত্যাদি জন্মে।
খ) দোঁয়াশ মাটিঃ গাইবান্ধা জেলার নদী তীরবর্তী বেলে মাটি এবং পশ্চিমে বরেন্দ্র ব্যাতিত সম্পূর্ণ ভূমিই দোঁয়াশ মাটি।
গ) এটেল মাটিঃ জেলার গোবিন্দঞ্জ থানার খিয়ার অঞ্চলে এটেল, দোঁয়াশ মাটি ও পাওয়া যায়। এই মাটিতে ধান, গম, ভূট্টা ইত্যাদি ফলন হলেও পাট ও সব্জী তেমন উৎপাদিত হয় না।
এই অঞ্চলে বন্যার মত দীর্ঘস্থায়ী অনাবৃষ্টি বা খরাও কয়েববর ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। খাদ্য দ্রবের দুস্প্রাপ্যতা এবং কাজের অভাব তখন প্রকটভাবে দেখা দিয়েছিল, ফলে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়েছিলো
১৭৬৮-৬৯, ১৮৫৭-৫৮, ১৮৬২-৬৩, ১৮৬৬-৬৭, ১৮৭৪, ১৯০৮-০৯ এবং ইদানিংকালের ১৯৯২-৯৩ সালের খরা এবং এর প্রভাব অত্র জেলার উল্লেখযোগ্য । তবে এগুলির মাধ্যে ১৮৭৪ এবং ১৯০৮-০৯ সালের দীঘস্থায়ী খরা এবং এর জন্যে অপুরণীয় ক্ষতি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্যে। ১৮৫৭-৫৮, ১৮৬২-৬৩, ১৮৬৬-৬৭, ১৯৯২-৯৩ সালে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাত না হওযায় এই খরার সৃষ্টি হয়েছিলা, সেচের অভাবে কৃষকেরা আমন ফসল চাষ করতে পারেনি। যারা কষ্ট করে খলে-বিলে থেকে পানি সেচ করে সামান্য জমিতে আমন চাষ করেছিল প্রচন্ড দবদাহে সেই শস্য ও পুড়ে গিয়েছিল। জেলার খাদ্যভাব হয়েছিল। যেমন ১৮৬৬ সালে টাকায় ৯৩ সের চাল ক্রয় করা যেত কিন্তু খরার ফলে এবং ব্যবসায়ীদের বদৌলতে ঐ সময় টাকায় মাত্র ৮ সের চাল ক্রয় করা যেত অর্থাৎ চালের সেরে ১২ ন্ডণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু পাশ্ববর্তী জেলাগুলো থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানি এবং পরবর্তী রবি মৌসুমে অন্যান শস্য উৎপাদন হওয়ায় খরার জন্য সৃষ্ট এই খাদ্যাভব দুর্ভিক্ষের পর্যায়ে পৌছায়নি। অবশ্য ইদানিং কালের খরা যেমন ১৯৯২-৯৩ সালে খীয়ার অঞ্চলে প্রকটভাবে হলেও কৃষকেরা গভীর, অগভীর সেচ যন্ত্রের সাহায্যে কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে দ্রব্যমুল্য খুব বেশী বৃদ্ধি পায়নি। ১৭৬৮ খৃষ্টাব্দে অনাবৃষ্টিতে সাবেক রংপুর জেলার ফসল উৎপাদন মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। দীর্ঘখরার বিভিন্ন শস্য ভান্ডারসহ সবকিছুই অগ্নিদগ্ধ ও ভস্মিভুত হয়। ১৭৬৯- ৭০ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রায় এক তৃতীয়াংশ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। তবে এই দুর্ভিক্ষের তীব্রতা বাংলায় সর্বত্র সমান ছিল না। সিরাজুল ইসলামের বাংলার ইতিহাসে ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বৃহত্তর রংপুর জেলার অন্তর্গত বর্তমানে গাইবান্ধা জেলাতেও এই দূর্ভিক্ষের প্রভাব ছিল অত্যন্ত বেশী। দুর্ভিক্ষের পুর্বে টাকায় ২ মন চাল পাওয়া গেলেও দুর্ভিক্ষের সময় টাকায় মাত্র ৩/৪ সের চল বিক্রি হয়েছে।
১৯০৭-১৯০৮ সালে পরপর দু’বার সংঘটিত খরা ছিল জেলার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। তবে এই খরা কিছুটা আঞ্চলিক, খীয়ার অঞ্চলেই এর প্রভাব ছিল বেশি। সাবেক রংপুর জেলা মিঠাপুকুর পীরগঞ্জ এবং গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার পশ্চিমাংশে এ খরায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মুলত: এই জেলার পূর্বাংশ দিয়ে বিভিন্ন নদ-নদী প্রবাহের কারণে বন্যা এলে উক্ত নিম্ন ভূমির আউশও আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পক্ষান্তরে পশ্চিমাংশের উচু লালমাটি এলাকা শুধুমাত্র এক ফসলী আমনের জমি স্বভাবতই খরা হলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। বর্তমানে বোরো ফসল ব্যাপক ভাবে চাষাবাদ করার ফলে এবং সেচ ব্যবস্থা আধুনিক হওয়ায় উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দুর্ভিক্ষের সম্ভবনা হ্রাস পেয়েছে।
ভূমিকম্প:
ব্রহ্মপুত্র উপতক্যায় অর্থাৎ আসাম অঞ্চলে ভূমিকম্পের হার অপেক্ষাকৃত বেশী। গাইবান্ধা জেলা ভুমিকম্প অঞ্চলের সন্নিকটস্থ হওয়ায় এই জেলাতে মাঝে মাঝে ভূমিকম্পন হয়। পূর্বের ভূমিকম্প গুলির কোন রেকর্ড না থাকলেও ১৮৮৫ সালের ভূমিকম্পের রেকর্ড রয়েছে সরকারি নথিতে। তবে ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে এবং এর প্রভাব উল্লেখযোগ্য। ভূমিকম্পের ফলে ভূ-পৃষ্টের দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হয়।
১৮৯৭ সালের ১২ ই জুন বিকেল ৫.১৫ মিনিটে স্থায়ী ভুমিকম্প বাংলা, বিহার ও আসামে ব্যাপক ক্ষতি করে। এর ফলে শষ্যাদি কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি, পাতকুয়া, রাস্তাঘাট, সড়কসেতু, রেলপথ বিধ্বস্ত হয় আবাদী জমি বালুচরে রুপান্তরিত হয়। এই ভূমিকম্পের ফলে ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ছোট ছোট শাখা নদী খালের তলদেশ উত্থিত হওয়ায় এন্ডলির গতি হ্রাস পায়। এর ফলে ছোট ছোট শাখা নদী খালের তলদেশ উত্থিত হওয়ায় এগুলির গতি হ্রাস পায় বা অনেক ক্ষেত্রে গতি পথ পরিবর্তন হয়েছিল। সারাই ও মানস নদী সুন্দরগঞ্জ ও গাইবান্ধা উপজেলায়, আখিরা ও নলেয়া খাল পলাশবাড়ি উপজেলায় এবং জেলার ঘাঘট নদীর গতি প্রবাহ হ্রাস পায় এবং এই উজেলার পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক বিল উচু হয়ে আবাদী জমিতে পরিণত হয়,আবার অনেক উচু ও আগাছাপূর্ণ জমি বিল কুড়ায় (গভীর খাদ) পরিণত হয়েছে। উল্লেখিত সময়ে পীরগঞ্জের বড়বিলা থেকে সৃষ্ট নলেয়া খাল গতিপ্রাপ্ত হয়েছিল। এই ভুমিকম্পের প্রভাবে সাবেক রংপুর জেলার গাইবান্ধা মহুকূমায়, অপেক্ষাকৃত বেশী পরিবর্তন হয়েছিল।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস